কুমিল্লা, বাংলাদেশের একটি ঐতিহাসিক শহর, যা প্রাচীন বাংলার ইতিহাস ও সংস্কৃতির অন্যতম কেন্দ্র ছিল। এই শহরটি দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত এবং বিভিন্ন প্রাচীন স্থাপনা ও ঐতিহ্যবাহী জায়গার জন্য বিখ্যাত। এর মধ্যে অন্যতম একটি আকর্ষণীয় স্থান হল শালবন বিহার ও কুমিল্লা যাদুঘর। এখানে ভ্রমণ করে আপনি বাংলা ইতিহাসের অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় সম্পর্কে জানতে পারবেন।
শালবন বিহার

শালবন বিহার কুমিল্লা শহর থেকে প্রায় ২ কিলোমিটার দূরে, কুমিল্লা-চট্টগ্রাম সড়কের পাশে অবস্থিত একটি প্রাচীন বৌদ্ধ বিহার। এটি প্রাচীন বৌদ্ধ সভ্যতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে পরিচিত। শালবন বিহার বাংলাদেশের একমাত্র বৃহত্তম বৌদ্ধ বিহারগুলির মধ্যে অন্যতম, এবং এটি ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত প্রাচীন বৌদ্ধ স্থাপত্যের নিদর্শন। এখানে প্রবেশ করে আপনি বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাস এবং প্রাচীন সময়ের সংস্কৃতির সাথে পরিচিত হতে পারেন।
শালবন বিহারের ইতিহাস
শালবন বিহার প্রায় ১৫০০ বছর আগে গঠিত হয়। এটি গৌতম বুদ্ধের শিষ্যদের জন্য একটি গুরুতর শিক্ষা কেন্দ্র ছিল। এটি প্রাচীন বাংলা অঞ্চলের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৌদ্ধ তীর্থস্থান হিসেবে পরিচিত। এই বিহারটি প্রায় ৩ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত, এবং এতে রয়েছে একাধিক উঁচু মন্দির, স্তূপ, পাথরের ভাস্কর্য এবং ধর্মীয় স্থাপনা।
- বিহারের নামকরণ: শালবন বিহারের নাম এসেছে এখানে থাকা শাল গাছের কারণে। এখানে একসময় শাল গাছের ঘন বন ছিল, যা সম্ভবত বিহারের নামকরণের কারণ।
- বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা: এটি শুধু একটি ধর্মীয় স্থান ছিল না, বরং এই স্থানটি বৌদ্ধ ধর্মের শিষ্যদের শিক্ষার জন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ছিল। এখানকার গ্রন্থাগারে হাজার হাজার পুঁথি ছিল, যা প্রাচীন বৌদ্ধ ধর্মীয় শিক্ষাকে সংরক্ষণ করত।
শালবন বিহারের মূল আকর্ষণ
- স্তূপ ও মন্দির: শালবন বিহারের মধ্যে বহু স্তূপ ও মন্দির রয়েছে, যার মধ্যে কিছু প্রাচীন কাল থেকে সংরক্ষিত রয়েছে। এখানকার স্তূপগুলো অত্যন্ত আকর্ষণীয় এবং তাদের প্রতিটি স্তূপের নিজস্ব ধর্মীয় গুরুত্ব রয়েছে।
- ভাস্কর্য ও পাথরের নির্মাণকর্ম: বিহারের প্রাচীন পাথরের ভাস্কর্য এবং মূর্তিগুলি আজও দর্শকদের জন্য আকর্ষণীয়। এখানে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের মূর্তি এবং অন্যান্য দেবতাদের ভাস্কর্য রয়েছে যা বৌদ্ধ সভ্যতার ইতিহাসকে প্রতিফলিত করে।
- মিউজিয়াম: শালবন বিহারের পাশে একটি ছোট মিউজিয়াম রয়েছে, যেখানে এখানে পাওয়া প্রাচীন ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ও বৌদ্ধ ধর্মের সম্পর্কিত নানা প্রতীক সংরক্ষিত রয়েছে।
কুমিল্লা যাদুঘর
শালবন বিহারের কাছেই কুমিল্লা যাদুঘর (Comilla Museum) অবস্থিত, যা কুমিল্লার ইতিহাস, সংস্কৃতি, এবং প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোর একটি দুর্দান্ত সংগ্রহস্থল। এটি শহরের অন্যতম প্রধান ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক আকর্ষণ।

কুমিল্লা যাদুঘরের ইতিহাস
কুমিল্লা যাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬৪ সালে, এবং এটি কুমিল্লা শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত। এটি স্থানীয় ইতিহাস এবং প্রত্নতাত্ত্বিক বিষয়গুলির প্রদর্শনীর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। এখানে প্রদর্শিত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলি প্রাচীন বাংলার ইতিহাস ও সংস্কৃতির ধারণা প্রদান করে। কুমিল্লা অঞ্চলের বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান থেকে উদ্ধারকৃত সামগ্রী এখানে সংরক্ষিত আছে।
কুমিল্লা যাদুঘরের মূল আকর্ষণ
- প্রাচীন মূর্তি ও ভাস্কর্য: কুমিল্লা যাদুঘরে প্রাচীন মূর্তি, ভাস্কর্য, এবং অন্যান্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রয়েছে যা বৌদ্ধ, হিন্দু, মুসলিম, এবং অন্যান্য সভ্যতার সাংস্কৃতিক প্রভাব তুলে ধরে। শালবন বিহারসহ কুমিল্লার অন্যান্য স্থান থেকে এসব নিদর্শন সংগ্রহ করা হয়েছে।
- পদ্মার প্রাচীন ব্রোঞ্জ ভাস্কর্য: যাদুঘরে একটি বিশেষ প্রদর্শনী রয়েছে যেখানে কুমিল্লার ইতিহাস এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য প্রদর্শন করা হয়েছে। এখানকার পদ্মার প্রাচীন ব্রোঞ্জ ভাস্কর্য বেশ পরিচিত এবং এটি দর্শকদের কাছে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।
- মধ্যযুগীয় মুদ্রা ও বিভিন্ন শিলালিপি: কুমিল্লা যাদুঘরে প্রাচীন মুদ্রা এবং শিলালিপি সংরক্ষিত রয়েছে, যা বাংলার ইতিহাস এবং সংস্কৃতির নানা দিক সম্পর্কে ধারণা দেয়।
কিভাবে পৌঁছাবেন
কুমিল্লা শালবন বিহার ও যাদুঘর শহরের মূল কেন্দ্র থেকে প্রায় ২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত, এবং শহরের যেকোনো জায়গা থেকে অটো বা রিকশা নিয়ে সহজেই পৌঁছানো যায়। যদি আপনি ঢাকার কাছ থেকে ভ্রমণ করেন, তবে কুমিল্লা যাওয়ার জন্য বাস, ট্রেন বা গাড়ি ব্যবহার করতে পারেন।
- ঢাকা থেকে কুমিল্লা: ঢাকা থেকে কুমিল্লার দূরত্ব প্রায় ১০০ কিলোমিটার এবং এটি বাস, ট্রেন, অথবা ব্যক্তিগত গাড়িতে ২-৩ ঘণ্টায় পৌঁছানো যায়।
সেরা সময় ভ্রমণ
কুমিল্লা এবং শালবন বিহার পরিদর্শনের জন্য সবচেয়ে ভালো সময় হলো শীতকাল, বিশেষ করে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত, যখন আবহাওয়া শীতল থাকে এবং ভ্রমণ করার জন্য আরামদায়ক।

কুমিল্লা শালবন বিহার এবং কুমিল্লা যাদুঘর একত্রে বাংলা ইতিহাস, প্রাচীন বৌদ্ধ সভ্যতা এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অমূল্য নিদর্শন। এখানে ভ্রমণ করলে আপনি শুধুমাত্র প্রাচীন শিল্পকর্ম ও স্থাপত্য দেখতে পারবেন না, বরং বাংলা সংস্কৃতির একটি অসাধারণ ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিত হতে পারবেন।